সরকারি চাকরিজীবী ও করপোরেটওয়ালাদের বেশ বড় মাপের সুবিধা দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী সরকারি চাকরিজীবীদের স্বল্প সুদে গৃহনির্মাণ ঋণ প্রদান এবং বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির কথা জানাবেন। একই সাথে করপোরেট কর কমানোর ঘোষণাও থাকবে এই বাজেটে। তবে মধ্যবিত্তদের সুবিধা দেয়ার জন্য ব্যক্তি আয়করমুক্ত সীমা বাড়ানোর কোনো কথা বলবেন না অর্থমন্ত্রী। ফলে কয়েক বছর ধরে আড়াই লাখ টাকা উপার্জনকারীদের আয়কর দেয়ার বিধান আগামী অর্থবছরেও চালু থাকছে। মধ্যবিত্তদের বিনিয়োগের নিরাপদস্থল সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর কথাও বলবেন অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে।
তবে অন্য বারের মতো ব্যাপক কর বৃদ্ধির কোনো প্রস্তাব থাকবে না এই বাজেটে। কারণ ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এই দিকে নজর দিয়ে বাজেটে কর হারের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আনছেন না অর্থমন্ত্রী। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হবে। একই সাথে আগামী অর্থবছরে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের মূলধন জোগানোর জন্য বরাদ্দ থাকছে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সরকারি চাকরিজীবীদের স্বল্প সুদে গৃহনির্মাণের জন্য বাজেটে ভর্তুকি রাখা হচ্ছে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার হবে চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। এই বাজেটে আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। সামগ্রিক ঘাটতি গিয়ে দাঁড়াচ্ছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার হবে এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংকঋণ নেয়া হবে ৪২ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য থাকছে ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৬৪ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা বেশি। আর চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় এর আকার ৯৩ হাজার ৭৮ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার রয়েছে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা, আর সংশোধিত বাজেটের আকার তিন লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা।
জানা গেছে, সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য পে- স্কেল অনুযায়ী ৫ শতাংশেরও বেশি হারে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা থাকছে, বাড়ানো হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাড়তি দু’টি উৎসব ভাতা ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা করেছেন। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর থেকে দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা, এনবিআর-বহির্ভূত করব্যবস্থা থেকে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা এবং করবহির্ভূত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অবশ্য বাজেটে চার হাজার ৫১ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা থাকছে। ওই অনুদান পাওয়া গেলে ঘাটতি দাঁড়াবে এক লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
বাজেটে ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেয়া হবে ৬০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। সেখান থেকে ১০ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা বিদেশী ঋণ পরিশোধে খরচ হবে। ফলে সরকারের নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ হাজার ১৬ কোটি টাকা। ঘাটতির বাকি ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা নেয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাকি তিন হাজার কোটি টাকা অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
আগামী বাজেট থেকে দেশী-বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৫১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় করতে হবে ৪৮ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণের সুদ দিতে হবে দুই হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ধরা হয় ৩৯ হাজার ৫১৩ কোটি আর বিদেশী ঋণের সুদ ধরা হয় এক হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির আকার ধরা হয়েছিল ২২ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে হয়েছে ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে জিডিপির আকার বেড়ে হবে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ল্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী।
চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ধরা রয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে তা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
ভ্যাটের স্তর কমছে : বর্তমানে দেড়, আড়াই, তিন, চার, সাড়ে চার, পাঁচ, সাড়ে সাত, ১০ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। আগামী অর্থবছরে তা কমে নয়টি হারের পরিবর্তে দুই, পাঁচ, সাড়ে সাত, ১০ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় হতে পারে। একই সাথে ব্যবসা শুরুর আগেই আদায়কৃত অগ্রিম ভ্যাটও (এটিভি) ১ শতাংশ বেড়ে ৫ শতাংশে উন্নীত হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় শিল্পে সুবিধা দিতে পণ্য ও সেবায় কিছু েেত্র ভ্যাট আরোপ ও কিছু েেত্র অব্যাহতি থাকছে।
করপোরেট কর কমছে : আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির করপোরেট করহার কিছুটা কমছে বলে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে। ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান দু’টি স্তরে (তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত) করহার দেড়-দুই শতাংশ কমানো হচ্ছে। সেই সাথে পুঁজিবাজারের বাইরে থাকা কোম্পানির করপোরেট করহারও দেড় শতাংশ কমছে।